রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ঝালকাঠির ১২৩টি মাদ্রাসায় নেই শহীদ মিনার

ঝালকাঠির ১২৩টি মাদ্রাসায় নেই শহীদ মিনার

ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ

যে ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে শহীদ হয়েছেন বাংলার দামাল ছেলেরা, সেই মাতৃভাষা বাংলা এখনও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপেক্ষিত মাদ্রাসাগুলোয়। বিশেষ করে নীতিমালাহীন ও বেসরকারিভাবে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসাগুলোয় বাংলা ভাষার চর্চা সীমিত। আর তাই ভাষা দিবসে দেশের বিদ্যালয়গুলোতে নানা আয়োজন থাকলেও মাদ্রাসায় নেই। কোনও কোনও আলিয়া মাদ্রাসায় অভ্যন্তরীণ আলোচনায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হলেও কোনও কওমি মাদ্রাসায় থাকে না কোন কর্মসূচী ও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। শুধু সরকারের বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত ছুটি পালিত হয় এসব মাদ্রাসায়।
ঝালকাঠি জেলার আলিয়া এবং কওমীর কোন মাদ্রাসাতেই নেই শহীদ মিনার। অপরদিকে ঝালকাঠি সদর থানার সামনে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেই সুষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষন। যার ফলে শিশু-কিশোররা শহীদ মিনারে জুতা পায়ে ওঠে খেলা করে। আবার বেসরকারী সংগঠনের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে শহীদ মিনারকে ঘিরে। কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ থেকে দূরে সরে গিয়ে তারা জুতা পায়ে উঠে পড়ে শহীদ মিনারে। ঝালকাঠির বিশিষ্টজনরা জানান, মসজিদ/মন্দিরে প্রার্থনার বাইরের সময়টাতেও কেউ জুতা নিয়ে ওঠে না। কিন্তু শহীদ মিনার-মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দিনে জুতা রেখে প্রবেশ করলেও বছরের বাকি সময়টাতে শ্রদ্ধা ভুলে জুতা পায়ে ওঠে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সবার প্রতি উপাসনালয়ের মতোই শহীদ মিনার-মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভে প্রতিটা সময়েই শ্রদ্ধা বহাল রাখার অনুরোধ জানান তারা।
জানা গেছে, দেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এসব মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম সরকার অনুমোদিত। সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকায় তাই ছোট আকারে পালিত হয় একুশে ফেব্রæয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সরকারের স্বীকৃতির বাইরে থাকা বেসরকারিভাবে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা ভাষা এবং একুশে ফেব্রæয়ারি বেশি উপেক্ষিত। গৌরবোজ্জ্বল দিনটি নিয়ে তাদের কোনও আয়োজন থাকে না। সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর রীতিকে ‘গুনাহের কাজ’ বলেই জানে এসব কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।

এক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে কঠোরভাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত দিবসগুলো পালনে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকায় কোনও কোনও আলিয়া এবং কওমি মাদ্রাসায় শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। কিছু মাদ্রাসায় একুশে ফেব্রæয়ারি নিয়ে দেয়ালিকাও প্রকাশিত হয়।

ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসা, ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, কুতুবনগর আযিযীয়া আলিম মাদ্রাসাসহ বেশিকিছু মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সবগুলোই বন্ধ। কোনও মাদ্রাসার অঙ্গনেই স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনও শহীদ মিনার নেই। ঝালকাঠি জেলায় কামিল মাদ্রাসা রয়েছে ১টি, ফাজিল মাদ্রাসা রয়েছে ১৯টি, আলিম মাদ্রাসা রয়েছে ১৬টি, ৮৭টি দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে বলে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়। তবে জেলায় কতটি কওমী মাদ্রাসা আছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই কোন দপ্তরেই।

জানা গেছে, ব্রিটিশদের ইংরেজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিহত করে ইসলামভিত্তিক শিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৮৬৬ সালে মাওলানা কাসেম নানুতবীর ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসাটিই কওমি মাদ্রাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ব্রিটিশদের শাসন আমল ও তার আগেও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ফার্সি ভাষার প্রচলন ছিল। এরপর উর্দুর প্রচলনও বাড়ে। কোরআন, হাদিসের গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় লিখিত হলেও এ অঞ্চলে ফার্সিতে অনুবাদ করা হয়। এরপর ১৯ শতকের আগে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী ও পরিসর উপমহাদেশীয় অঞ্চলে বৃদ্ধি পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালে আরবি-ফার্সি ভাষার গ্রন্থগুলোর উর্দু ভাষায় শরাহ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কওমি মাদ্রাসাগুলো ফার্সি ও উর্দুনির্ভর হয়ে পড়ে। ধর্মীয় বইগুলো আরবিতে লিখিত হলেও এগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হয় ফার্সি ও উর্দু ভাষাতেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশক পার হলেও সে প্রভাব অব্যাহত আছে।

জানা গেছে, এসব মাদ্রাসায় নয়টি শ্রেণি (স্তর) তাইসির, মিজান, নাহুমির, হেদায়াতুন নাহু, কাফিয়া, শরহে জামি, জালালাইন, মেশকাত, বুখারি শরিফ নামে পরিচিত। এই শ্রেণিগুলোর মধ্যে তিন স্তরে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলা পড়ানো হয়। এরপর শুধুই আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় পাঠদান করা হয়। নুরানি মক্তব এবং হেফজতে শুধু কোরআন শিক্ষার জন্য পড়ানো হয়। তাইসির, মিজান, নাহুমির জামাতে (শ্রেণি) বাংলা পড়ানো হয়। তবে শুধু তাইসিরে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পড়ানো হয় ব্যাকরণ। মিজান, নাহুমির জামাতে বাংলায় পড়ানো হয় ভূগোল ও সামাজিক বিজ্ঞান। এরপরের শ্রেণিগুলোতে বাংলা নেই। তবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আরবি-ফার্সি-উর্দু হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই উত্তর দেয় বাংলায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা গাজী মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আগে মাদ্রাসাগুলোতে শহীদ দিবস পালন হতো না, এখন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক মাদ্রাসায় সীমিত আকারে হলেও পালিত হচ্ছে। আর রাষ্ট্রীয় দিবস পালন করা সবার উচিত। দেশের বিধান মানতে ধর্মে কোনও বাধা নেই।’

ঝালকাঠি জেলা শিক্ষা অফিসার মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, সরকারীভাবে মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় দিবস উদযাপনের নির্দেশনা রয়েছে। অনেক অনেক মাদ্রাসা দিবসটি পালনও করে। কিন্তু শহীদ মিনার নির্মাণে কোন বরাদ্ধ না থাকায় মাদ্রাসায় শহীদ মিনার স্থাপন করছেন না মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

 

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  




All rights reserved@KathaliaBarta 2023
Design By Rana